ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর
কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ পর্ব
ব্রিটিশ ভারতের প্রথম জেলা যশোর। দেশ বিভাগের পূর্বে জেলার উচ্চ শিক্ষার পশ্চাদপদতা থেকে উত্তরণে জেলা সদরে একটি প্রথম শ্রেণির কলেজ প্রতিষ্ঠা-চিন্তার সূত্রপাত হয়। এই প্রেক্ষাপটে জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার গঙ্গানন্দপুর গ্রামের সন্তান, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংসদের সদস্য ও কলকাতা বঙ্গবাসী কলেজের অধ্যাপক শ্রী মহিতোষ রায় চৌধুরী কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৪০ সালের আগস্ট মাসে স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় রায়বাহাদুর শ্রী কেশবলাল চৌধুরী, যশোর পৌরসভার সভাপতি সুরেন্দ্রনাথ হালদার এবং তৎকালীন জেলা জজ এস. কে. গুপ্ত (আই.সি.এস) এর উপস্থিতিতে শ্রী ক্ষিতিনাথ ঘোষকে সম্পাদক করে ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট এক কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয়। কলেজ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাটি জনপ্রিয় করে তুলতে ১৫০ সদস্যের আরও একটি সাধারণ কমিটি গঠন করা হয়।
উক্ত কার্যনির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৯৪১ সালের জুলাই মাসে কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। তখন দরকার হয় কলেজের জন্য জমি ও ভবন সংগ্রহের কার্যনির্বাহী কমিটি মেডিকেল ইনস্টিটিউটের সভাপতি শ্রী কেশবলাল রায় চৌধুরী এবং সম্পাদক পূর্ণ গোপাল বসুর নিকট কলেজের জন্য তাঁদের অব্যবহৃত জমি ও ভবন (মেডিকেল ইনস্টিটিউটের স্বীকৃতি লাভে ব্যর্থ হওয়ায়) দান করার প্রস্তাব দেন। কার্যনির্বাহী কমিটির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৪১ সালের ১৮ মার্চ ৮টি শর্তের ভিত্তিতে তাঁদের ৪০,০০০/- টাকার সম্পদ (একটি একতলা ও একটি দুইতলা ভবন) কলেজের জন্য দান করে। এর ফলে শহরের চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন (বর্তমান ফাতিমা হাসপাতালের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে) তৎকালীন মেডিকেল ইনস্টিটিউটের দুটি ভবনে ‘যশোর কলেজ’ নামে কলেজের আনুষ্ঠানিক শ্রেণি কার্যক্রম হয়। ড. ধীরেন্দ্র নাথ রায়কে কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ভিন্ন একটি উৎস থেকে জানা যায়, হযরত গরীব শাহ’র তত্ত্বাবধানে সুখন বিবির বাড়িতে ১৯২২ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুল ও হাসপাতাল’ এর একাংশে ১৯৪১ সালে ‘যশোর কলেজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪১-১৯৪২ শিক্ষাবর্ষে ১৪৬ জন শিক্ষার্থী (১৪২ ছাত্র ও ৪ জন ছাত্রী, তন্মধ্যে হিন্দু ১০৯ ও মুসলিম ৩৭ জন) নিয়ে কলেজটির যাত্রা শুরু হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন এম এম কলেজ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন কলেজে মিত্রবাহিনী ঘাঁটি স্থাপন করায় শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হলে কলেজ কর্তৃপক্ষ হাটবাড়িয়া জমিদারের কাচারি বাড়িতে (বর্তমান ফায়ার সার্ভিস অফিসের পাশে) কলেজটি সাময়িকভাবে স্থানান্তর করেন। ১৯৪৫ সালে কলেজটি পূর্বের জায়গায় প্রত্যাবর্তন করে। ১৯৪৬ সালে বাবু ক্ষিতিনাথ ঘোষ, নীলরতন ধর, শ্রী বিজয়কৃষ্ণ রায়, শ্রী নগেন্দ্রনাথ ঘোষ, শ্রী বিজয় রায়, খান বাহাদুর লুৎফর রহমান, এ্যাডভোকেট ওয়ালিয়ার রহমান, এ্যাডভোকেট আব্দুর রউফ, চারুচন্দ্র দত্ত, রায়বাহাদুর কেশবলাল চৌধুরী, শ্রী বিশ্বেশ্বর সরকার, দানবীর শ্রী রণদা প্রসাদ সাহা, জনাব আব্দুর রহমান, জনাব আব্দুস ছুবহান, জনাব ওয়াজেদ আলী আনসারী প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের জমি দান ও হাত ধরে যশোরের কৃতী সন্তান মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের নামানুসারে কলেজটির নামকরণ করা হয় ‘মাইকেল মধুসূদন কলেজ’ সংক্ষেপে এম এম কলেজ।
১৯৫৬ সালের ১০ ডিসেম্বর কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন খড়কীর পীর সাহেব মরহুম শাহ্ সুফি মৌলানা মহম্মদ আবুল খায়ের (র.) এর দ্বিতীয় পুত্র জনাব মো: আব্দুল হাই। তাঁর সময়ে কলেজে বিকম (পাস) ও বিএসসি (পাস) কোর্স চালু হয়। ১৯৫৯ সালে কলেজের পরিসর বৃদ্ধির জন্য জনাব মো: আব্দুল হাই জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এম. রুহুল কুদ্দুস এর সহযোগিতায় কলেজটি চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে বর্তমান অবস্থানে (খড়কী মৌজায়) স্থানান্তর করেন এবং তৎকালীন সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করেন। তখন জমি সংগ্রহের জন্য খড়কীর পীর সাহেব মরহুম শাহ সুফি মৌলানা মহম্মাদ আবুল খায়ের (র.) ও হাজী মো: মোরশেদ বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। মুন্সী নাসির উদ্দীন, মো: আব্দুল লতিফ, মো: মাহাতাব বিশ্বাস, মো: আলী, জবুর আলী জোয়াদ্দার, মো: দলিল উদ্দিন, শরীফ শামছুর রহমান, মোঃ ইমান আলী, আব্দুস ছুবাহান প্রমুখ দানশীল ব্যক্তিবর্গের দানকৃত জমির ওপর দাঁড়িয়ে বর্তমান দক্ষিণবঙ্গের শ্রেষ্ঠ এই বিদ্যাপীঠ।
১৯৬০ সালে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এম রহুল কুদ্দুস ‘আব্দুল হাই কলা ভবন’ এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এক্ষেত্রে ইঞ্জিনিয়ার ফারুকী, এ্যাডভোকেট সৈয়দ শামসুর রহমান, এ্যাডভোকেট রওশন আলী, শ্রী পশুপতি বসু, শ্রী শতীশ কুমার দত্ত, জনাব ইমান আলী মাস্টার, শহিদ শ্রী সুধীর কুমার ঘোষ, প্রফেসর মো: শরীফ হোসেনসহ কলেজের তৎকালীন অধ্যাপকবৃন্দের অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। ১৯৬২ সালে কলেজটিতে প্রথম বাংলা, অর্থনীতি ও ভূগোল বিষয়ে অনার্স কোর্স চালুর মধ্য দিয়ে উচ্চ শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত হয়। ১৯৬৩ সালে ইতিহাস বিষয়ে অনার্স চালু হয়। ১৯৬৮ সালের ১ মে কলেজটির জাতীয়করণ করা হয়।
ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে কলেজের ভূমিকা
১৯৫২ সালে মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৫৮ এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামে এ কলেজের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের শিক্ষার্থীরা দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামে পাকিস্তানী হায়েনা ও তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে শহিদ হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে নিম্নলিখিত সূর্যসন্তানদের নাম উদ্ধার সম্ভব হয়েছে।
শহিদ মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নামের তালিকা
শহিদ শিক্ষকবৃন্দ
১। শহিদ নবীন চন্দ্র ঘোষ, প্রভাষক, গণিত বিভাগ
২। শহিদ সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, প্রভাষক, বাণিজ্য বিভাগ
শহিদ শিক্ষার্থীবৃন্দ
১। শহিদ মো: আসাদুজ্জামান, ভূগোল শেষপর্ব
২। শহিদ এস এম নজরুল ইসলাম, বি এ ফলপ্রার্থী
৩। শহিদ নিমাই চন্দ্ৰ সাহা, বি কম ফলপ্রার্থী
৪। শহিদ আবুবকর সিদ্দিকী, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী
৫। শহিদ মফিজুর রহমান (হেম), উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী
৬। শহিদ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী
স্বাধীনতাত্তোর কাল পরবর্তী কলেজের অগ্রগতির চিত্র
১৯৭৩ সালে কলেজটিতে বিজ্ঞান ক্লাব ও ১৯৭৬-১৯৭৭ সালে বাণিজ্য সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর পুনরায় কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন জনাব মো: আব্দুল হাই এবং ১৯৮১ সালের ১০ জানুয়ারি কর্মরত অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। উল্লেখ্য, কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকে অদ্যাবধি যাঁরা অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁদের মধ্যে জনাব মো: আব্দুল হাই এর অবদান সর্বাধিক। ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন খড়কীর পীর সাহেব মরহুম শাহ্ সুফি মৌলানা মহম্মদ আবুল খায়ের (র.) সাহেবের ভ্রাতুষ্পুত্র প্রফেসর মোঃ শরীফ হোসেন। তিনি কলেজ মসজিদ নির্মাণ কাজ সমাপ্তকরণ ও ‘বুক ব্যাংক’ প্রকল্প চালুসহ কলেজের সার্বিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৯১ সালের ৩১ অক্টোবর কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন প্রফেসর কাজী মু. কামরুজ্জামান। ১৯৯১-১৯৯২ শিক্ষাবর্ষে পদার্থবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, গণিত, রসায়ন, ব্যবস্থাপনা ও হিসাববিজ্ঞান এই ৬টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু হয়। ১৯৯২-১৯৯৩ শিক্ষাবর্ষে কলেজটিতে প্রথম মাস্টার্স কোর্স খোলা হয়। ১৯৯৫-১৯৯৬ শিক্ষাবর্ষে ইংরেজি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু হয়। ১৯৯৭ সালে কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক কোর্স তুলে দেওয়া হয়। ২০০৮ সালে পুনরায় কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক কোর্স চালু হয়। ১৯৯৭-১৯৯৮ শিক্ষাবর্ষে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, ইসলামী শিক্ষা ও প্রাণিবিদ্যা বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু হয়। বর্তমান কলেজটিতে ১৯টি বিষয়ে অনার্স কোর্স এবং ১৭টি বিষয়ে মাস্টার্স কোর্স চালু রয়েছে।